বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আমার বাবার কথা    

  • সিমিন হোসেন রিমি   
  • ৩ নভেম্বর, ২০২০ ০৭:৪৫

সেই ছোটবেলার কথা যদি ধরি, তবে প্রথমেই বলতে হয় রূপকথা কখনই আমাকে আকৃষ্ট করেনি, যতটা আকৃষ্ট হতাম আমার বাবার ছোটবেলার কাহিনী শুনে। আমার কাছে বাবা ছিলেন আমার স্বপ্নের রাজপুত্র। আকাশের তারার মাঝে তাকে আমি খুঁজতাম।

বাবার কথা ভীষণ মনে হয়। এমন কোনো দিন যায় না, যে দিন আমি তাকে স্মরণ না করি। তিনি আমার কাছে এত বেশি পবিত্র, এত বেশি ভালোলাগার, এত বেশি শ্রদ্ধার যে, আমি তাকে যত বেশি মনে করি না কেন, তাতে বিন্দুমাত্র আমার মন ভরে না। শুধুই তিনি আমার বাবা এভাবে আমি তাকে কখনই ভাবিনি, আজও ভাবতে পারি না।

সেই ছোটবেলার কথা যদি ধরি, তবে প্রথমেই বলতে হয় রূপকথা কখনই আমাকে আকৃষ্ট করেনি, যতটা আকৃষ্ট হতাম আমার বাবার ছোটবেলার কাহিনী শুনে। আমার কাছে বাবা ছিলেন আমার স্বপ্নের রাজপুত্র। আকাশের তারার মাঝে তাকে আমি খুঁজতাম। সাড়ে চার বছরের আমি এক গভীর রাতে কারাগারের পথে যেতে তাকে ঘুমঘুম চোখে বিদায় দিয়েছিলাম (১৯৬৬)। আর যখন আবার তিনি ফিরে এলেন (১৯৬৯), তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি।

আমার আজও মনে আছে-কত বয়স হবে আমার তখন, বড় জোর চার বা কিছু বেশি। আমাদের বাসার নিচতলার সামনের দিকের বারান্দায় আমি বাবার কোলে বসে আছি। বাবার দিকে মুখ করে আমার দুই পা দুই দিকে ঝুলিয়ে। বাবা আমাকে ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের’ গল্প বলছিলেন। সেই আমার তার কাছ থেকে প্রথম গল্প শোনা আর সেটাই শেষ। এই গল্প শোনার অনেক বছর পর জেনেছিলাম, বাবা প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ওঠেন, তখন তাকে উপহার হিসেবে আলিবাবার ইংরেজিতে লেখা একটি বই আর একটি কলম দেয়া হয়েছিল স্কুল থেকে। আমার আজ ভাবতে ভালো লাগে স্কুল থেকে পাওয়া তার জীবনের প্রথম উপহার তিনি আমাকে গল্পচ্ছলে উপহার দিয়েছিলেন।

সত্যিকার অর্থে বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় কারাগারে। সেই ভোর, অন্ধকার থাকতে আমাদের ছুটতে হতো তখনকার সেই ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে দিকে। মাসে দু’বার আমরা ময়মনসিংহ কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। যেদিন আমাদের বাবার সঙ্গে দেখা করবার তারিখ থাকত, তার আগের রাত থেকে আমার মনে কেমন যেন একটা ঈদ-ঈদ ভাব আসত। ময়মনসিংহ কারাগার আমার কাছে ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। আর রেলগাড়ি ছিল প্রিয় বাহন। রেলগাড়ির একটানা কু…ঝিঁকঝিঁক শব্দ আমার মনকে আকুল করে দিত, আমি রেলগাড়ির জানালার পাশে বসে ঝিঁকঝিঁক শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে কত শত শত শব্দ তৈরি করতাম। একটা শব্দ অনেকক্ষণ বলবার পর আর যখন মনে ধরত না তখন নতুন শব্দ তৈরি করতাম। সবচাইতে মজা লাগত যে জিনিসটা সেটা ছিল আমি যত শব্দই তৈরি করতাম, সবই রেলের একটানা সুরের সঙ্গে মিলে যেত। একটানা সুরকে হারিয়ে দিতে আমি আরো শব্দ তৈরি করতাম। কিন্তু প্রতিবার আমিই হেরে যেতাম। রেলের ঝাঁকুনিতে আমাদের কামরার অনেকেই যখন ঘুমিয়ে পড়ত আমার খুব মজা লাগত দেখতে। বড় বড় চোখ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম সবাইকে। আর যদি আমার পাশে বসা কাউকে দেখতাম ঘড়ি হাতে, তাকেই সবচাইতে বেশি পছন্দ করতাম। বার বার জানতে চাইতাম কটা বাজে আর আমরা কখন পৌঁছাব। আম্মা বিরক্ত হয়ে যেতেন আমার এতবার সময় জানতে চাওয়ায়।

আমরা ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে গিয়ে আব্বুর এক বন্ধুর বাড়িতে উঠতাম। সেখানে খুব সুন্দর একটি ময়না পাখি ছিল। ছোট ছোট শব্দ দিয়ে তৈরি কথা বলতে পারত। ওদের খাবার ঘর আর রান্না ঘরে যাবার ছোট বারান্দার পাশে ময়না পাখিটা খাঁচায় ঝুলে থাকত। খাবার টেবিলে বসে পাখিটাকে খুব পরিষ্কার দেখা যেত। আমার নানীর কাছ থেকে শুনেছিলাম নানীরও একটি ময়না ছিল। আমি নানীর পাখি দেখিনি। গল্পে শুনা ময়না পাখিকে আমি এই পাখির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করতাম।

একসময় সময় হতো কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবার। যে রাস্তা দিয়ে আমাদের যেতে হতো, তার দুপাশে ছিল চিরসবুজ পাইনের মতো কোনো গাছ। অল্প একটু জায়গা জুড়ে ছিল সেই গাছগুলো, কিন্তু আমার ওটুকুই দেখতে খুব ভাল লাগত। আমার কাছে সেই গাছগুলোর নামের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আজও আমি সেই গাছগুলোর সৌন্দর্যের কথা ভেবে আনন্দিত হই।

একবার এক অদ্ভূত মজার ঘটনা ঘটল। আমাকে আর আমার বড় বোন রিপিকে কারাগারের ভেতরে ঢুকবার অনুমতি দিয়ে আসল ফটকের তালা খুলে দেয়া হলো। আমরা দুই বোন দুইজন সেপাইয়ের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলাম। টানা অনেকটা পথ হেঁটে আমরা এসে দাঁড়ালাম বাবা যে ঘরটায় থাকে তার সামনে। সে ঘরটায় অনেক গুলো লোহার খাঁটিয়া পাতা। আমরা যে দিক দিয়ে ঐ ঘরটায় ঢুকেছিলাম তার ঠিক বাঁ দিকের প্রথম খাঁটিয়াটা ছিল বাবার। আমাদের চারপাশে তখন বেশ ভিড় জমে গেছে। পাঁচ-সাত বছরের দু’টো মেয়েকে দেখতে সবাই এগিয়ে এসেছে। তখন আর আমাদের হাঁটতে হচ্ছে না একজনের কাছ থেকে আরেক জনের কাছে। এভাবে ঘর ছেড়ে ফুলে ফুলে ভরা এক বাগানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। জানলাম বাবার নিজ হাতে তৈরি এ বাগান। তখন হঠাৎই মনে হয়েছিল আমার টকটকে ফর্সা রঙ বাবা সারাদিন রোদে পুড়ে কেমন যেন বাদামি রঙের হয়ে গেছে।

বাবা মাসে একবার হলেও আমাদের চিঠি লিখতেন। রিপি সবসময় উত্তর দিত। আমি তখনও  ভালো লিখতে জানি না, তাই শুধু বানান করে পড়েই আনন্দ পেতাম। আমার মনে আছে একবার বাবার চিঠির সঙ্গে কোনো এক খবরের কাগজের কাটিং এসেছিল। এক বিস্কিটের বিজ্ঞাপনে ছোট্ট একটি মেয়ের ছবি। পাশে বাবা বসে লিখেছিলেন ‘রিমির মতো দেখতে তাই ছবিটা কেটে রেখেছিলাম।’ সেই ছোট্ট আমার সেদিন কত যে ভালো লেগেছিল। আজ যখন আমি রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের কাবুলিওয়ালার সঙ্গে আমার বাবাকে এক হয়ে যেতে দেখি তখন বাবার ভালোবাসা, স্নেহ, আদর পাবার আশায় আমার দু’চোখের পানি কিছুতেই বাঁধ মানতে চায় না।

১৯ আগস্ট আমার জন্মদিন। আমি যে বার ছয় বছরে পা দিলাম, ঠিক তার তিন দিন পর ময়মনসিংহ কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেছি। ওয়েটিং রুমে মোটা মোটা লোহার গরাদ ধরে আমি এর রিপি বাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম বাবা আসছেন হাতে টিনের কৌটায় সবুজ একটি গাছ। ওয়েটিং রুমের ভেতরে ঢুকে আমার সামনে গাছটি নিয়ে বললেন, ‘আমার রিমির জন্মদিনে এটা বাবার দেয়া উপহার।’

সেটা একটি ডালিম গাছ ছিল। আমি আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে গাছটির যত্ন করতাম। দেখতে দেখতে সেই টিনের কৌটার ছোট্ট গাছটি আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। ’৭১-এর শুরুতে ডালিম ধরেছিল। ’৭২-এর পহেলা জানুয়ারি আমি আর আমার প্রিয় গাছটিকে পাইনি। ’৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনীর সমস্ত নিষ্ঠুর বর্বরতার মাঝে আমার গাছটিও ছিল একটি শিকার।

বাবার দেয়া উপহারে সেদিন আমার মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মনে নেই। কিন্তু আজকে ছোট্ট এই ক’টি লাইন লিখতে গিয়ে আমার এত বছরের জমে থাকা অব্যক্ত কান্নাকে চেপে রাখতে পারলাম না। সাত আকাশের সীমাহীন বিশালতার মধ্য দিয়ে বাবা কি দেখতে পাবেন সেই ছোট্টবেলার কথা মনে করে ঘরের এক নিভৃত কোণে বসে তার মেয়ে ঝরিয়ে চলেছে অঝর চোখের জল? 

দেখতে দেখতে ’৭১ এসে গেল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর সাধারণ নির্বাচন। পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র। অসহযোগ আন্দোলন। নিরস্ত্র বাঙালির উপর চাপিয়ে দেয়া হলো নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড।

সমস্ত কিছু উলোট-পালোট হয়ে গেল। আমার বাবা আমার স্বপ্নে ঠাঁই নিল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ জয় করে বিজয় মুকুটে সাজলো এই বাংলাদেশ। নিপুণ কারিগরের মতো ‘যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে’ এই বিশ্বাসে যে মানুষটি গোটা নয়টি মাস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জীবন পণ রেখে কাজ করে গেছেন, তিনি যুদ্ধ জয়ের পর প্রিয় মাতৃভূমিকে দৃঢ়ভিত্তিতে দাঁড় করাবেন বলে নিজেকে যেন উৎসর্গ করলেন দেশের কাজে। দু’বছর ১০ মাসের মাথায় ’৭৪ এর অক্টোবর মাসে বাবা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। এই পদত্যাগের পরেই সত্যিকার অর্থে ১৩ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে আমার আসল পরিচয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার আমার সব কিছু হারিয়ে গেল। মাত্র ৯টা মাস স্বপ্নে স্বপ্নে শেষ হয়ে গেল। ১৫ আগস্ট আমরা গৃহবন্দি হলাম। ২২ তারিখে বাবাকে বাসা থেকে কারাগারে নিয়ে গেল। ঠিক বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে আম্মা বলছিলেন, ‘কী মনে হয় কবে ছাড়বে?’ বাবা আলতো করে তার হাতটা আমাদের চার ভাই-বোনের মাথায় ছুঁয়ে বলেছিলেন, ‘মনে করো চির জীবনের জন্য যাচ্ছি।’

চির জীবনের জন্য চলে যাওয়াটা যে এমনভাবে ঘটবে তা আমার শত কল্পনাতেও ছিল না সত্যি কিন্তু একটি মৃত্যু যে খুব কাছাকাছি, তা বুঝতে কেমন যেন কোনো অসুবিধাই হচ্ছিল না। এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম, বাবা আর কোনোভাবেই বাঁচবেন না। সকালে উঠেই আম্মাকে স্বপ্নের কথা বলেছি। ঠিক সাত দিনের মধ্যে সব কিছু শেষ হয়ে গেল।

এই দেশকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে, মুক্তিযুদ্ধের তিন বীরসহ আমার বাবাকে সরকারের হেফাজতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মাধ্যে সমস্ত বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর নিষ্ঠুর, নৃশংসভাবে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করা হলো। আমি আবার তারা ভরা আকাশে খুঁজতে লাগলাম বাবাকে। আমার এ খোঁজার কোনো শেষ নেই, তবুও আমি খুঁজেই চলেছি। হয়ত সারা জীবন চলবে এই অনন্তের অনুসন্ধান।

লেখক: সিমিন হোসেন রিমি, জাতীয় সংসদ সদস্য

এ বিভাগের আরো খবর